নয়নে বেদনার মেঘ

বন্ধুত্ব নাকি ছলনা (নভেম্বর ২০২৩)

মোঃ মাইদুল সরকার
  • ৬২
গাড়িটা গলির মুখে ঢুকতেই লুকিং গ্লাসে সেই ছাতিম গাছটা দেখা গেল। গাড়িটা আস্তে আস্তে সেই বিশাল ছাতিম গাছের নিচে এসে থেমে গেল। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন ছত্রিশ বছর বয়সের এক সুন্দর যুবক। যুবকের নাম শাহাদাত চৌধুরী।

তিনি দাঁড়িয়ে গাছটাকে দেখলেন, গাছ ভর্তি ছাতিম ফুল আর ফুলের সুন্দর ঘ্রাণে চারপাশ মৌ মৌ করছে। কিছু কিছু ঘ্রাণ যেন মানুষকে অতীতে নিয়ে যায় ।হঠাৎ চোখ বন্দ করে যেন ছাব্বিশ বছর আগের দিনটিতে ফিরে গেলেন শাহাদাত চৌধুরী।

চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে শাকির মাহমুদের সাথে বন্ধুত্ব ছিল শাহাদাত চৌধুরীর। একই ক্লাশে পড়তেন তারা। শাহাদাত মেধাবী ছাত্র তাই শাকির তাকে পছন্দ করতো।

সময়টা তখন শাহাদাতদের ভালো যাচ্ছিল না। আর্থিক, সামাজিক অবস্থা মিলে তাদের দিনগুলো বেশ খারাপ যাচ্ছিল । এর মধ্যেই এসএসসি পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসলো। কিন্তু পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে পারছিল না শাহাদাত।

কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। তার এই অবস্থা দেখে চেয়ারম্যানের ছেলে সাকির বলল, আরে দোস্ত এত টেনশনের কি আছে ? চল আমার বাবার কাছে যাই। বাবাকে গিয়ে বললেই তোকে রেজিস্ট্রেশনে টাকাটা দিয়ে দিবে। বাবা এমনিতেই কত টাকা কত মানুষ কে দিয়ে দেয় তার হিসেব নেই।

যাবে কি যাবে না। টাকার জন্য তার এস এস সি পরীক্ষা দেওয়া হবেনা এই ব্যাপারটা বলবে কি বলবে না, এসব ভাবতে ভাবতে সময় নষ্ট হচ্ছিল শাহাদাতের।

শাহাদাত মেধাবী ছাত্র আর শাকির কোনরকমে পাস করা ছাত্র। শাকির তাই শাহাদাতকে হিংসে করত। শাহাদাতের সঙ্গে পড়ালেখায় কোন দিন পারবেনা জেনে তার অবস্থার সুযোগ নিয়ে শাকির তাকে করুণা করতে চায়।

বিকেল হয়ে এসেছে। রোদের তেজ পরে গেছে। চেয়ারম্যান সাহেব তখন কয়েকজন লোক নিয়ে বিভিন্ন কাজের কথা বলছিলেন এমন সময় ছেলে শাকির তার বন্ধুর রেজিস্ট্রেশন এর জন্য টাকা চাওয়াতে তিনি বিরক্ত হলেন।

তিনি শাহাদাতকে ডেকে বললেন, তোমার বাবা কি করে ? শাহাদাতের গলা এমনিতেই শুকিয়ে আসছিল সে কোন রকমের বলল, কৃষিকাজ করে।

চেয়ারম্যান শামসুল হক ছিলেন অহংকারী মানুষ। শুনে হেসে তিনি বললেন, কৃষকের আবার শখ হয়েছে তার ছেলেকে ম্যাজিস্ট্রেট বানাবে। তিনি মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ভালো ।বেশ ভালো। তা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে তুমি আমার উপকার করবে তো ?

শাহাদাত কি বলবে বুঝতে পারছেনা। সে মাথা নীচু করে দাড়িয়ে আছে। শাকিরের বাবা পকেট থেকে পাঁচশত টাকার দুটি নোট বের করে তিনি শাহাদাতের উপর ছুড়ে মারলেন।

অপমানে আর রাগে শাহাদাতের দুটি চোখে পানি চলে আসে। সে তখন কোন কিছু না বলে সে বাড়ি থেকে টাকাগুলো ফেলে চলে আসে।। তারপরে হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে ছাতিম গাছটার নিচে এসে একটু বসে জিরোতে থাকে।

শাহাদাত চোখ মুছে ভাবতে থাকে শাকির কি তাকে ইচ্ছে করে অপমান করার জন্য তাদের বাড়িতে নিয়ে গেল নাকি সত্যিকারের সাহায্য করার জন্য এনেছিল ? যদি সত্যিই সে বন্ধুকে ভালোবাত তাহলে এতক্ষনে সান্তনা দিতে ছুটে আসতো। অত্যন্ত একবার এসে বলতে পারতো- বাবার এমন ব্যবহারে তুই কষ্ট পাস না। তাহলে কি শাকির বন্ধুত্বের নামে ছলনা করে তাকে এভাবে অপমান করল?

পেটে খাবার নেই। ক্ষুধায় পেট জ্বলছে। তার উপর এই অপমান যেন মনে হচ্ছে মাটির সাথে মিশে যায়। ছাতিমের তীক্ষ্ন গন্ধ যেন ক্ষুধাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল । দুচোখ বেয়ে কেবল অশ্রুপাত করা ছাড়া আর কোনই গতি ছিল না শাহাদাতের।


হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে শাহাদাত আল্লাকে বলতে লাগলো তার চোখের ভাষায়, তুমি ছাড়া আমার আর কোন পথ নেই। তুমি আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো।

অসহায়ের আকুল আর্তি আল্লাহ কখনো বিফলে যেতে দেননা।

ঠিক তখনই হারুন স্যার এই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে শাহাদাতকে দেখে বললেন, কিরে কি হয়েছে বাবা। এখানে এভাবে মনমরা হয়ে বসে আছিস ক্যান ?

সে তখন স্যারকে বললো, কি আর হবে স্যার, গরিবের যা হবার তাই হয়। ক্ষুধার জ্বালা, অর্থের জ্বালা, সম্মানের জ্বালা, দারিদ্রতার জ্বালা। এইসব গুলো মিলে আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। আমার আর হয়তো এসএসসি পরীক্ষাটা দেওয়া হবে না। কষ্টে আবার ডুকরে কেঁদে উঠল শাহাদাত।

কেন দেওয়া হবে না ! আমি আছি না তোর পাশে । স্যার পকেট থেকে আটশত টাকা বের করে শাহাদাতের হাতে দিয়ে বলল, যা এখনই বাড়ি যা। কালকের মধ্যে ফরম ফিলাপ করে ফেলবি। তুই একদিন অনেক বড় হবি তখন আর আজকের এই দুঃখ কষ্ট তোর থাকবে না। মনে রাখিস চিরদিন মানুষের সময় এক যায় না। আজকে যারা তোকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে, অপমান করেছে, ছোট করেছে তারাও একদিন এর সাজা পাবে।

শাহাদাত পরের দিনই ফরম ফিলাপ করে ফেলে এবং হারুন স্যারকে জানায় তার ফরম ফিলাপ হয়ে গেছে, সে পরীক্ষা দিতে পারবে।

স্যার তখন তাকে পাশে বসিয়ে নিজের জীবনের একটি ঘটনা শোনায়। আমার বাড়ি সিলেটে। ছোট বেলায় বাবা মারা যায়। অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি। একটি মাত্র শার্ট ছিল। সেটা রোজ স্কুলে পড়ে যেতাম। বন্ধুরা হাসাহাসি করতো। কটু কথা শোনাত। মতিন ছিল বড় লোকের ছেলে। সে প্রতিদিন নতুন নতুন জামা পড়ে আসতো।




একদিন সে আমাকে তার একটা নতুন শার্ট উপহার দিল। আমি সরল মনে তার সেই উপহার নিলাম এবং খুশি হয়ে সেই শার্ট পড়ে স্কুলেও কয়েকদিন আসলাম।
কিন্তু এরপর একদিন সে স্যারের নিকট বিচার দিল যে, আমি নাকি তার শার্ট চুরি করেছি। আমি স্যারকে বললাম আমি চুরি করিনি। মতিন আমাকে এটা উপহার দিয়েছে।

স্যার মতিন কে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এটা হারুনকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলে ? সে বলল, না আমি উপহার দেইনি সে আমার বাসা থেকে এটা চুরি করেছে।

আমি তখন বললাম স্যার ওর বাসা তো আমি চিনি না তাহলে ওর বাসা থেকে আমি কিভাবে শার্ট চুরি করব। আর চুরি করার যদি আমার ইচ্ছাই থাকে তাহলে একটা শার্ট কেন কয়েকটা শার্টইতো চুরি করতে পারতাম।

শিক্ষক আমার সততা এবং সরলতা সম্পর্কে জানতেন। তিনি মতিন ও আমাদের অন্য বন্ধুদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে, তদন্ত করে জানতে পারলেন মতিন চালাকি করে আমার উপর চুরির অপবাদ চাপিয়েছে।

তখন শিক্ষক সবার সামনে তাকে বেত দিয়ে প্রহার করলেন এবং বললেন যারা বন্ধুত্বের সরলতার সুযোগ নিয়ে এমন অপবাদ দেয় তারা কখনো ভালো মানুষ হতে পারেনা এবং জীবনে উন্নতি করতে পারে না।

শিক্ষকের সেই ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল। পরবর্তী জীবনে আমি শিক্ষকতায় পেশায় আসলেও আমার সেই বন্ধু জীবনে কোন কিছুই করতে পারিনি বরং একদিন তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তার সেই দুরবস্থা দেখে আমার চোখে পানি এসেছিল। যে ছেলে প্রতিদিন নতুন নতুন জামা গায়ে দিত তারা গায়ে আজ শোভা পাচ্ছে শত ছিন্ন একটি পুরান রং উঠা শার্ট।

বুঝতে আর বাকি রইল না তার জীবনে কি ঘটে গেছে। তখন আমি তাকে একটি শার্ট উপহার দেই এবং কিছু টাকা দিয়ে সহায়তা করি। সে তখন কেঁদে বলে, তোমার উপর সত্যি সেদিন অবিচার করেছিলাম বলেই খোদা আমাকে শাস্তি দিয়েছেন।

ঘটনা শেষ করে স্যার বললেন, সবাই তার কর্মফল ভোগ করে কেউ দুদিন আগে কেউ দুদিন পরে।

তুমিও দেখবে একদিন যারা তোমার সাথে অন্যায় করেছে তারাই তোমার কাছে আবার একদিন মাথা নত করবে।



সময়মত এসএসসি পরীক্ষা দেয় শাহাদাত। স্কুলের সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করে সে। এভাবেই ভালো রেজাল্ট করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে কালের পরিক্রমায় সে আজকে বাড়ি, গাড়ির মালিক।

বাবা একটু সাহায্য করো না। দুদিন ধরে কিছু খাইনি। একটি কম্পিত কন্ঠের আওয়াজ শুনে শাহাদাত অতীত থেকে বাস্তবে ফিরে। সে দেখে একজন বৃদ্ধ তার কাছে সাহায্যের আশায় হাত বাড়িয়েছে।

একশত টাকার একটা নোট দিয়ে শাহাদাত লোকটির হাত চেপে বলল, আপনাকে আমার অনেক চেনা মনে হচ্ছে। তারপর সে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে চমকে উঠল।

এই সেই চেয়ারম্যান ছাব্বিশ বছর আগে যে তাকে অপমান করে টাকা ছুড়ে মেরেছিল। আজকে সেও পথের ফকির। আজকে সে টাকা চাইছে শাহাদাতের কাছে। সময় মানুষকে কোথায় এনে দাড় করায়।

একেই বলে অহংকারের পতন। চেয়ারম্যানের এই অবস্থা থেকে শাহাদাতের মনটা কেঁদে উঠলো। তাকে হোটেলে নিয়ে খাওয়া দাওয়া করালো।

শাহাদাত তার বন্ধু সম্পর্কে জানতে চাইল- বলল চাচা আপনার না একটা ছেলে ছিল শাকির তার নাম। সে কোথায় কি করছে ?

ছেলের কথা শুনে চেয়ারম্যান হু হু করে কেঁদে উঠলো। আমার সন্তান ছিল, সম্পদ ছিল, সবই ছিল । কিন্তু আজ কিছুই নেই। আমার অনাচার আর পাপের ফলে আমি আমার সন্তান হারিয়েছি। সম্পদ হারিয়েছি। সম্মান হারিয়েছি।

শাহাদাত স্তম্ভিত হয়ে গেল চেয়াম্যানের জীবনের করুণ কাহিনী শুনে। শত হলেও বন্ধুর বাবাকে সে এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেবেনা। সে চেয়াম্যানকে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিল।


ছেলের বন্ধুর এমন মহত কাজ দেখে তিনি বললেন, তোমার মত ছেলে বাংলার ঘরে ঘরে জন্মাক। দোয়া করি তুমি আরও বড় হও।

রাতে বাসায় ফিরে স্ত্রী ও মেয়েকে শাহাদাত ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বলল। মেয়ে বলল, বাবা সত্যি তুমি মহৎ মানুষ।

শাহাদাতের স্ত্রী বলল, তোমার মত কিছু ভাল মানুষ আছে বলেই সমাজে এখন শান্তি আছে।

শাহাদাত তার মেয়ে ও স্ত্রীকে বলল, আশা করি তোমরাও এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে চলবে। অন্যের ভাল কিছু করার চেষ্টা করবে কিন্তু ক্ষতি করবেনা।


নয়নে যে বেদনার মেঘ জমে একদিন তা শেষ হয়ে যায়। সুখ ও সাফল্যের সূর্যটা চেষ্ট করলেই নিজের করে নেওয়া যায়। আর সব বিষয়ে প্রতিশোধ নিতে হয়না কেবল অপেক্ষা করলেই ফলাফল দেখা যায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Muhsin Ahmed "সকাল বেলার আমির রে তুই ফকির সন্ধ্যাবেলা।" সত্যি সময় কখন কাকে কী অবস্থায় ফেলে বুঝা কঠিন। সম্পদশালী হওয়ার সাথে দায়িত্ব সচেতন হলে মানুষ কখনো ঠুনকো সাময়িক সম্পদ নিয়ে এতো অহংকারী হত না। দারুণ শব্দমালা মাথায় গেঁথে আছে, "ক্ষুধার জ্বালা, অর্থের জ্বালা, সম্মানের জ্বালা, দারিদ্র্যের জ্বালা।" লা জাওয়াব।
আপনার গঠনমূলক মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাই। শুভকামনা রইল।
বিষণ্ন সুমন ভারী শিক্ষামূলক গল্প। আপনার সুযোগ্য কলমে প্রাণ পেয়েছে।
ধন্যবাদ ভাই, ভাল থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
mdmasum mia সুখ ও সাফল্যের সূর্যটা চেষ্ট করলেই নিজের করে নেওয়া যায়। আসলেই কি তাই ? সুন্দর শিক্ষনীয় গল্প।
কারো কারো জন্য তো তাই। ধন্যবাদ।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

সরলতা ও দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে যারা বন্ধুত্বের সাথে ছলনা করে তারা কোন দিন ভাল ফল পায়না গল্পে সেটাই তুলে ধরা হয়েছে।

২৪ আগষ্ট - ২০২০ গল্প/কবিতা: ৯৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪